পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-১৫)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৮:১২:৫২ সকাল
মিথিলা বাবু!
পুরানা বন্ধুদের ভিতর টিংকু ছাড়া আর যারা প্রাইমারি শেষে স্কুল ছেড়েছিল তাদের একজন খালেক। সে প্রাইমারি পাসের পরে তরকারির ব্যবসা শুরু করে ফুটপাথে বসে।
আরেক বন্ধু ছিল টুটুল। ওর বাবা ছিলেন হোমিওপ্যাথির ডাক্তার। টুটুলের বোনকে বিয়ে করেছিল পুর্ববাঙ্গলা কম্যুনিস্ট পার্টির একজন রাজনৈতিক সাইডের নেতা শিমুল। সে বি এল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এম এ করেছিল। যখন এস এস সি পাস করে বি এল কলেজে ভর্তি হলাম তখন টুটুলও একই কলেজে ভর্তি হয়। টুটুলের মাধ্যমে আমার শিমুল ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়। সেসব অনেক পরে।
আগে আমার এস এস সি'র রেজাল্টের কথা বলি।
ওই সময় ছোট খালার সংসারে একটা বড় পরিবর্তন হল। খালুর জমিজমার বিরোধ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে রূপ নেবার পর খালুর অধ:পতন খুব দ্রুত হল। এই পতনের সংগী হবার ভয়ে ছোটখালা খুব সহজ একটা পথ খুঁজে নিলেন। প্রাইমারী স্কুলের সহকারী শিক্ষক পদের জন্য পরীক্ষা দিলেন। চাকরীটা হয়েও গেল। ছোট খালা আমার নানাবাড়ির গ্রামের সরকারী প্রাইমারি স্কুলে যোগ দিলেন। মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়িতেই থেকে গেলেন। যাওয়ার আগে ছোট খালা বিদায় নিতে এলে মা ছোট খালাকে একবারের জন্য ও না করলেন না। একটু গম্ভীর থাকলেন, কিন্তু রাগ দেখালেন না। ছোটখালু বাবাকে ধরে চেষ্টা করলেন, কিন্তু বাবাও কেমন দায়সারা চেষ্টা করলেন। আমার মনে হলো বাবা মা বরং খুশিই হয়েছেন। বিয়েটা দিয়ে বাবাকে মায়ের কাছে মনের কষ্ট প্রকাশ করতে শুনেছি অনেক বার।
এর মধ্যে একদিন গ্রাম থেকে বাবার এক বোন তার ছেলে নিয়ে বেড়াতে আসেন। ইনি তোমার বিনু দাদী। আমাদের বিনু ফুপু। উনাকে তুমি ছোট বেলায় দেখেছো। উনার কাছ থেকে জানলাম, দাদী গ্রামে ফিরে মাসখানেকের মধ্যেই জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি তার অন্য দুই ছেলের কাছ থেকে একেবারে আলাদা হয়ে যেতে চাচ্ছেন। সম্পত্তি ভাগ হয়ে যাবে। দাদী দাদীর অংশ নিয়ে আলাদা একটা ঘর তুলবেন। উঠান আগের মতই এক থাকবে। দাদীর সাথে থাকবেন বিনু ফুপু তার দশ বারো বছর বয়সী ছেলেসহ। বাবার মামাতো বোন, আমার এই বিধবা ফুপুকে তার শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তি থেকে কিছুই দেয়া হয়নি। দাদী ফুপুর ছেলের পড়ালেখার দায়িত্ব নিয়েছেন। দুই চাচা প্রথমে খুব রাগারাগি করেছে। দাদী অল্প কথার মানুষ হলেও জেদী। তারা দাদীকে কিছুতেই মানাতে পারছেন না। দাদী বাবাকে একবার বাড়ি যেতে বলেছেন। চাচারাও অপেক্ষা করছেন। খবর নিয়ে বিনু ফুপু এসেছেন।
মা অনেক বছর পর বিনু ফুপুকে পেয়ে উচ্ছ্বল হয়ে উঠলেন। বিনু ফুপু অবিরাম কথা বলেন। দেখলাম উনার ছেলেটা একদম উল্টো। ঘরে ঢুকে মা'কে সালামটাও নি:শব্দে করল। পায়ে হাত দিয়ে। মা আমাদের সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দিলেন। ইনি তোমার মুজাম্মেল চাচু। যিনি এখন ভার্সিটির প্রফেসর। ও আমার কাছাকাছি বয়সী হলেও বাদলের সাথেই ওর ভাব হল।
বাদল আর ও ড্রইংরুমে বিছানা পেতে টিভি দেখছিল। আমি ড্রইং রুমের সামনে বারান্দায় লাইট নিভিয়ে আধো অন্ধকারে হাটছি। খুব অস্থির লাগছিল। পরের সপ্তাহে আমার এস এস সি'র রেজাল্ট। আগের দিন মিলাদ হয়েছে। মা মহল্লার মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে মানুষ পাঠিয়েছিলেন যাতে উনি আমার রেজাল্টের জন্য বিশেষ দোয়া করেন। বারান্দা থেকেই বাদলের গল্প শুনছিলাম। বিষয় ঘুরেফিরে আমিই। হাসি পেলো। বাদল মুজাম্মেলের কাছে আমাকে পৃথিবীর সেরা ছাত্র বানিয়ে ফেলেছে। আমার কেমন ভয় হচ্ছিল। পরীক্ষা খারাপ হয়নি। কিন্তু যদি খারাপ কিছু হয়!
পরদিন স্কুল থেকে আমাদের দু'জন স্যার মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে চলে এলেন। বোর্ডে গিয়ে টেবুলেশন শীট দেখে এসেছেন। রেজাল্ট পেয়ে গেলাম। বিশ্বাস করতে কষ্ট হল। পরীক্ষা ভালো হয়েছিল, কিন্তু এতটা হবে ভাবিনি। বোর্ডে সপ্তম। সম্মিলিত দশম। রাজ্য জয়ের সুখ নিয়ে মা'কে খবর জানাতে উড়ে গেলাম রান্নাঘরে। বিনুফুপু খুশিতে কেঁদে ফেললেন। গলা থেকে সোনার চেইন খুলে দিয়ে আমার হাতে দিলেন। বললেন, ' আরো অনেক বড় হও।' আমি গয়না দিয়ে কী করবো বুঝতে না পেরে মা'র দিকে তাকিয়ে রইলাম। মা হেসে চেইনটা নিয়ে নিজের কাছে রাখলেন। বললেন, ' এখন আমার কাছে থাক। '
চা খেয়ে স্যাররা মা'কে বলে গেলেন সাংবাদিক আসতে পারে। আমাকে বললেন স্কুলে যেতে। আমি বোকা বোকা চেহারা নিয়ে হেসে হেসে স্যারদের পিছনে পিছনে রওনা দিলাম।
হেডস্যারসহ সব শিক্ষককে সালাম করে ফেরার পথে কেমন অদ্ভুত লাগছিল সব। স্কুলের গেট থেকে বের হয়ে মনে হল, 'স্কুল থেকে বের হয়ে গেছি! 'তীব্র এক কষ্ট মনকে কিছুক্ষণ অবশ করে রাখল। একটু পরই একই তীব্রতায় খুশি অনুভব করলাম, ' কলেজে উঠে গেছি! কেমন লাগছিল সবকিছু! কিছু আগের মত না। আমার সব আলো আলো লাগছিল।
সৈয়দ পরিবারের মেয়ে লাভলি ওদের দোতলার একটা জানালা থেকে জোরে আমার নাম ধরে ডাকল। জানালার দিকে তাকিয়ে ওকে দেখে লজ্জায় আমার কান গরম হয়ে গেল। ওকে আমার খুব ভালো লাগত। অনেক দুষ্টু ছিল। কিন্তু অমন সুন্দর কোন মেয়ে আমি আর কখনো দেখিনি। অন্যদিন হলে লাজুক হেসে চুপচাপ চলে আসতাম। সেদিন মন এত ভালো ছিল, বেশ জোরে জিজ্ঞেস করলাম, ' ভালো আছো? ' লাভলি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর এমন হাসতে লাগল। এমন হাসিকে বোধ হয় কাচভাংগা হাসি বলে। আমি পা চালিয়ে চলে আসতে আসতে হাসিমুখে আরেকবার পিছনে ফিরে দেখলাম। লাভলি জানালা ধরে দাঁড়িয়ে তখনো হাসছে। ওর জন্য আমার ভালোলাগাটা অনেক দিনের। একতরফা ভালোলাগা। মেয়েটি আমাকে পাত্তা দিত না। সে তার ভাই ও চাচাদের দিয়ে ওকে বিরক্ত করার কথা বলে নালিশ করে আগের বছর আমাকে বকা খাইয়েছিল। এস এস সি পরীক্ষার রেজাল্ট এর পর সব উল্টে গেল। লাভলি ওর বান্ধবীর হাতে আমার রেজাল্টের শুভেচ্ছা জানিয়ে কার্ড পাঠাল। আমি এক নতুন পৃথিবীতে পা রাখলাম।
জীবনের আরো অনেক রহস্যই আমার সামনে, খুব কাছাকাছিতেই দাঁড়ানো, তখন জানতাম না। স্বপ্নের ঘোরে পড়লাম।
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
৮৭৭ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আগের পর্বে মন্তব্যের ঘরে জমা দিতে পারিনি কিছুই। মানষিক নিঃস্বতা সব বিষয়েই আসলে আকাল ছড়িয়ে যায়!তাই.......!!
উত্থানের সাথে পতনও সমান তালে চলে!কেন যে মানুষতা ভূলে যায়-ছোটখালুর মত!!
পরিক্ষা পরবর্তি অনুভূতির বর্ণনা মুগ্ধ করল!
অনেক অনেক শুভ কামনা জানাই!
জাযাকাল্লাহু খাইরাল জাযাই.....।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
"দিন দিন ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী!"
এটা আমার অনুভূতি! কেমন যেন ঘোলাটে মনে হচ্ছে! কয়েক দুনিয়া সম হোক আপনার পৃথিবী-এই শুভ কামনা মামুন ভাই!!!
ভালোলাগার অনুভুতি রেখে গেলাম মামুন ভাই!
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন